ক্যারিয়ার গঠনে সংযোগ স্থাপন ও আচরণ

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - ক্যারিয়ার শিক্ষা - NCTB BOOK

সংযোগ স্থাপন ও ক্যারিয়ার

যোগাযোগ স্থাপন বলতে প্রথমেই আমাদের চিন্তায় কী আসে একবার ভেবে দেখ তো। দুটো জিনিসকে সংযুক্ত করা কিংবা একাধিক বস্তুকে একসাথে যুক্ত করা, তাই না? ইলেকট্রনিকস হলে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে যুক্ত করা যেতে পারে, অন্য কোনো বস্তু হলে অন্য কোনোভাবে। কিন্তু একাধিক ব্যক্তিকে কি একসাথে যুক্ত করা যায়? তাহলে তোমরা অন্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করবে কীভাবে?

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে সকল মানুষ পাশাপাশি একত্রে বসবাস করে। এই মানুষেরা কি পরস্পরের

সাথে যুক্ত? এমন কী হতে পারে যে, সমাজের সকল মানুষ আসলে অদৃশ্য কোনো বন্ধনে পরস্পরের সাথে

সংযুক্ত? আমরা কি জানি- সেই অদৃশ্য বন্ধন কী?মানুষ হিসেবে আমরা একে অন্যকে যেমন শ্রদ্ধা করি, তেমনি দল-মত নির্বিশেষে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করতে চাই। পৃথিবীর সকল মানুষ আসলে মায়ার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। পরিচিতজনদের প্রতি আমাদের এই মায়ার পরিমাণটা অনেক বেশি। আমরা আমাদের পরিচিতজনদের কাছাকাছি থাকতে চাই, সবসময় তাদের মঙ্গল কামনা করি। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শুধু সামাজিক জীবনেই নয়, কর্মক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার বিদ্যমান। কর্মক্ষেত্রে সকলেই একটি অদৃশ্য বন্ধনে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।

কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হলে অনেক কিছু জানতে হবে, শিখতে হবে। সেসব শুধু বই পড়ে

শেখা যায় না। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। তাছাড়া, কর্মক্ষেত্রের

বিশাল এক জগৎ থেকে নিজের পছন্দের কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে হলে চাই একে

অপরের সাথে জানাশোনা ও বড়দের পথনির্দেশ।

এসো আমরা কয়েকজন মানুষের জীবনের ঘটনা শুনি

কেস স্টাডি ১ : আশিস রঞ্জন দে কুমিল্লায় বাস করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে খুব পছন্দ করতেন। যেখানে যার সাথেই তার দেখা হতো, তিনি তাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতেন। তাদের সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। পড়াশোনা শেষ করার পর আশিস রঞ্জন দে একটি চাকরি পেলেন। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল, তিনি নিজের মতো করে একটা ব্যবসায় দাঁড় করাবেন। কী ব্যবসায় করলে ভালো হয় তা নিয়ে তিনি পরিচিত মানুষের সাথে কথা বললেন। তার পূর্ব- পরিচিত ঢাকায় একজন নামকরা ব্যবসায়ীর কাছেও আশিস উপদেশ চাইলেন। সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক আশিসকে বললেন, 'ঢাকায় টাটকা সবজি পাওয়া খুব কঠিন। ঢাকার বড় বড় ডিপার্টমেন্টল স্টোরে সবজির নিয়মিত জোগান দিতে পারলে খুবই ভালো হয়। এই ব্যবসায় ভাবনাটা আশিসের ভালো লাগল। তিনি খোঁজ করে দেখলেন, ঢাকায় তার পরিচিত বেশ কয়েকজনের এ ধরনের ব্যবসায় রয়েছে। আশিস তাদের সাথে যোগাযোগ করে কোন ধরনের সবজি তাদের প্রয়োজন,কেমন দাম তারা দিতে পারবেন এবং কী পরিমাণ চাহিদা ইত্যাদি জেনে নিলেন। তারপর, এলাকার কয়েকজন সবজি চাষির সাথে কথা বললেন। সবজি চাষিরা তাকে জানাল, সব সময় তারা ভালো দাম পায় না । আবার, অনেক সময় যখন সবজি বিক্রির সময় আসে তখন ক্রেতা না পাওয়ার কারণে সবজি নষ্ট হয়ে যায়। আশিস একটা ট্রাক ভাড়া নিয়ে সবজি ক্ষেত থেকে টাটকা সবজি সংগ্রহ করে ঢাকায় সবজির জোগান দেওয়া শুরু করলেন। সবাই খুব খুশি হলো। কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পেল। ঢাকার বড় বড় দোকানের মালিকরা ক্রেতাদের নিকট ভালো সবজি বিক্রি করতে পেরে খুশি। সবাই আশিসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। আর তার ব্যবসায়ও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল ।

কেস স্টাডি ২ : চাঁদপুরের ছোট্ট একটি গ্রামে জান্নাতুল ফেরদৌস বাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে নিজের গ্রামেই একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সংস্থার মাধ্যমে তিনি এলাকার মানুষকে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। শিক্ষাজীবনে তাকে শিক্ষকেরা প্রায় বলতেন জীবনে উন্নয়নের জন্য সব সময় সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে। এ কথা তিনি প্রায়ই মনে করেন। তাই তার পরিচিত সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। তিনি এখানে যাদের সঙ্গে পরিচিত হন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তিনি সব সময় তার এলাকার বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, শিশুদের ডায়রিয়া ও পানি বাহিত রোগের প্রকোপ, এগুলো নিয়ে ভাবতেন আর কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার পথ খুঁজতেন। ঢাকার একটি সেমিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে তার পরিচয় ঘটে। এ পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। একদিন ঐ কর্মকর্তা জানালেন জান্নাতুলের সংস্থার মাধ্যমে তার এলাকার সমস্যা সমাধানে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে জান্নাতুল তার এলাকার সমস্যা সমাধানে সক্ষম হলেন।

উল্লিখিত দুজন মানুষের জীবনের গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম? সম্পর্ক স্থাপন মানে চারপাশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া। তবে শুধু পরিচিত হলেই হবে না। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। কাজেই, সম্পর্ক স্থাপন হলো কারও সাথে পরিচিত হয়ে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। আশিস ও জান্নাতুল ফেরদৌসের জীবনের গল্প থেকে আমরা জেনেছি যে, তাদের।

কর্মক্ষেত্রে সফল হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ।

সম্পর্ক স্থাপন অনেক রকম হতে পারে। যেমন-

• ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন (যেমন আমাদের সহপাঠীদের সাথে আমরা ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে থাকি; তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলি। বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়াই) ।

পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন (পেশাগত প্রয়োজনে, আমাদের অনেকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। পেশাগত জীবনে সহকর্মীসহ অনেকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়)।

• সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন (একই সমাজে আমরা যারা বসবাস করি, তারা পরস্পরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকি)।এছাড়াও সম্পর্ক স্থাপন আরও অনেক রকম হতে পারে। তবে যেখানে যেমনই হোক না কেন, সম্পর্ক স্থাপন মানেই হলো যোগাযোগ স্থাপন এবং তা নিয়মিত রক্ষা করে চলা। নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলে স্থাপিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সম্পর্ক স্থাপন যে শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির হয় তা কিন্তু নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংঘের সাথেও সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে । যেমন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তবে, এখানে আমরা শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়েই শিখব।

ক্যারিয়ারের সফলতায় সম্পর্ক স্থাপন

ক্যারিয়ার গঠন তথা জীবনে সাফল্যের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বর্তমান পৃথিবীতে অনেক চাকরি অভ্যন্তরীণভাবে হয়ে থাকে অর্থাৎ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়ে পরিচিত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার বা পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়ার খরচ বাঁচায় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই জীবনে চলতে-ফিরতে পরিচিত হওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করা দরকার। কে, কখন, কোন কাজের খবর দিতে পারে তা আগে থেকে বলা যায় না । তাই ক্যারিয়ারের ও সামাজিকতার স্বার্থে পারস্পারিক যোগাযোগ অপরিহার্য ।

এখন দেখি ক্যারিয়ারে সফল হতে হলে চাকরি পাওয়ার আগে এবং চাকরিরত অবস্থায় কাদের সাথে

আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে:

১. আশপাশে এবং স্কুল-কলেজে পরিচিত জন ;

২. কোনো অনুষ্ঠান বা সামাজিক সম্মেলনে নতুন পরিচিতমুখ ;

৩. আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব:

৪. অফিসের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী; ৫. প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাগণ;

৬. কর্মরত প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক;

৭. ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়-

১। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী; ২। নিজ প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী;

৩। গ্রাহক;

৪। ব্যবসায় অন্য যে সকল পণ্য বা সেবা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল সে সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি;

৫ । স্থানীয় উদ্যোক্তা;

৬। স্থানীয় সরকারি প্রশাসনঃ

৭। বিজ্ঞাপন প্রচারকারী ও গণমাধ্যম।সম্পর্ক স্থাপনে করণীয়:

* আন্তরিকতার সাথে কুশল বিনিময়

* দেখা হলে কিছুটা সময় একসাথে আলাপ-আলোচনা করা : * বিপদে-আপদে পরিচিতজনদের খোঁজ-খবর নেওয়া

* সাধারণ আগ্রহের বিষয়ে সব সময় কথা বলা

* ব্যক্তিগত কিন্তু গোপনীয় বা স্পর্শকাতর নয় এমন বিষয়ে কথা বলা

* হাসিখুশি থাকা এবং কথায় ও কাজে আন্তরিকতা প্রকাশ করা: * সামাজিক উৎসব এবং অনুষ্ঠানে খোঁজ-খবর নেওয়া ও শুভেচ্ছা বিনিময়

* সমস্যায় পড়লে সাহায্য করা

* সম্পর্কের ক্ষেত্রে সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও গোপনীয়তা বজায় রাখা।

ঘটনা : জামান সাহেব এবং আজহার সাহেব একই অফিসে দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরি করছেন। তাদের দুজনের মধ্যে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান। অফিসের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও তাদের একে অপরের বাসায় যাতায়াত আছে। এই তো সেদিনই জামান সাহেবের মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়েছিলেন আজহার সাহেব। পরস্পর ভালো সম্পর্ক থাকলেও তাদের আচরণগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। জামান সাহেব কাজে কোনো প্রকার ফাঁকি দেন না। সময়মতো সব কাজ করে তিনি জমা দেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাকে কীভাবে, কখন সহায়তা করবেন সে বিষয়ে আমান সাহেব অভি সতর্ক। অধঃস্তন কর্মকর্তাদের সাথেও তার সম্পর্ক খুব ভালো। অন্যদিকে আজহার সাহেব অত্য একজন কর্মকর্তা হিসেবে অফিসে সুপরিচিত। কোনো দিন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কেউ পায়নি। তিনি অফিসে দেরি করে আসেন নি। সহকর্মীদের সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত চায়ের আড্ডাগুলোতে তাকে খুব একটা মুখর হিসেবে দেখা যায় না। যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে তিনি কাজ করেন ডার সাথে তিনি সর্বক্ষণ যোগযোগ করেন এমন নয়। তবে প্রতিদিন সব কাজ ঠিকমতো করে জমা সেন। একদিন সবাই শুনতে পেল আমান সাহেবের পদোন্নতি হয়েছে।এসো ভালো শ্রোতা হই

যোগাযোগ রক্ষায় ভালো শ্রোতা হওয়া খুবই জরুরি। কোনো কিছু শোনা মানেই ভালো শ্রোতা হওয়া নয় । ভালো শ্রোতা অন্যের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেন এবং যা শোনেন তা নিয়ে ভাবেন । আমাদের চারপাশে অনেকেই প্রচুর কথা বলেন এবং অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না বা খানিকটা শুনলেও তা ভাবনা-চিন্তার গভীরে নেন না। এরা কোনোভাবেই ভালো শ্রোতা নন। ভালো শ্রোতার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা দেখে বোঝা যায় যে তিনি ভালো শ্রোতা। যেমন-

>> একজন ভালো শ্রোতা মনোযোগ দিয়ে বক্তার বক্তব্য শোনেন; শোনার সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন

না ।

>> একজন ভালো শ্রোতা সাধারণত বেশির ভাগ সময় বক্তার চোখে চোখ রেখে তার বক্তব্য শোনেন ।

> একজন ভালো শ্রোতা বক্তব্যের সাথে একাত্ম হয়ে যান। তিনি যা শুনছেন সে অনুযায়ী তার অভিব্যক্তি (যেমন- মৃদু হাসা, অবাক হওয়া, দুঃখের অভিব্যক্তি দেওয়া ইত্যাদি) পরিবর্তন হয়।

> একজন ভালো শ্রোতা অন্যের কথা বলার সময় নিজে কথা বলেন না। সময় ও সুযোগ বুঝে অথবা অন্যের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে তিনি কথা বলেন।

> একজন ভালো শ্রোতা কারও বক্তব্য শোনার সময় হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন না। এখন ভেবে দেখ তো তোমাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কি না? আমাদের সবার মধ্যেই ভালো শ্রোতা হওয়ার গুণাবলি কম-বেশি রয়েছে। আমাদেরও উচিত ভালো শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ, কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য ভালো শ্রোতা হওয়া খুবই প্রয়োজন ।ভালো শ্রোতা হওয়ার কৌশল

উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা

একজন গুণী মানুষ যেমন উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ শুরু করেন না, তেমনি একজন ভালো শ্রোতাও গঠনমূলক কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো কথায় কর্ণপাত করেন না । একজন ভালো শ্রোতা শোনার আগেই ঠিক করে নেন, কী কী তথ্য তার প্রয়োজন এবং কীভাবে সেই সকল তথ্য তিনি মনে রাখবেন। মনে রাখার জন্য একজন ভালো শ্রোতা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করে থাকেন; যেমন মুখ্য শব্দ মনে রাখার কৌশল (এক্ষেত্রে শ্রোতা মুখ্য শব্দসমূহ মনে রাখেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জ্ঞান হিসেবে তার পূর্বে শেখা বিষয়ের সাথে একীভূত করে নেন)। তবে, অধিক তথ্যের ক্ষেত্রে শ্রোতা সেগুলোকে নোট করে বা টুকে নেয়। শোনার আগেই যদি উদ্দেশ্য ঠিক করে নেওয়া যায়, কিংবা কী কী তথ্য জানা প্রয়োজন তা ঠিক করে নেওয়া যায় তবে শোনা তথ্য মনে রাখা সহজ হয় ।

মনোনিবেশ করা

ভালো শ্রোতা হতে হলে অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। কোনো কিছু মনোযোগ দিয়ে শোনা সহজ ব্যাপার নয়; এজন্য অনুশীলন ও চেষ্টার প্রয়োজন । অনেকের ক্ষেত্রেই কখনো কখনো কারো কথা বা বক্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকে আবার খুব দ্রুত অন্যের বক্তব্যের গভীরে মনোনিবেশ করতে পারেন । এ জন্য চেষ্টা ও অনুশীলন প্রয়োজন ।

মানসিক ও শারীরিকভাবে স্থির থাকা ভালো শ্রোতা হতে হলে কোনো কিছু শোনার সময় মানসিক ও শারীরিকভাবে স্থির থাকতে হবে । কেউ যখন

কথা বলেন বা বক্তব্য প্রদান করেন, তখন অনেকেই বিভিন্ন রকম কাজ করেন, নানা রকম চিন্তা-ভাবনা

করেন। এ রকম অবস্থায় মনোযোগ দিয়ে শোনা যায় না। কাজেই মনোযোগী শ্রোতা হতে হলে কোনো কিছু

শোনার সময় অবশ্যই আগ্রহ থাকতে হবে এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে স্থির থাকতে হবে।

চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা

আমাদের দেশে গুরুজনদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা বা কথা শোনাকে অনেকেই অভদ্রতা মনে করে

থাকেন। কিন্তু কোনো কিছু মনোযোগ দিয়ে শোনার ক্ষেত্রে চোখের মাধ্যমে যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রোতা বক্তার চোখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই অনুমান করতে পারেন; বিষয়বস্তুর গভীরে গিয়ে মানসিক

যোগাযোগ তৈরি করতে পারেন। ফলে, শোনা বিষয়টি অনেক অর্থবহ হয়।

কথার মাঝে কথা না বলা

অন্য কেউ যখন কথা বলেন, তখন আমাদের কথা বলা উচিত নয়। কেউ কথা বলার সময় যদি আমরা কথা বলি, তবে একদিকে আমরা যেমন তার কথা ভালোভাবে শুনতে পারি না; তেমনি তিনিও আমাদের কথা শুনতে পারেন না । কাজেই মনোযোগী শ্রোতা হতে হলে অন্যরা যখন কথা বলেন তখন নিজে নিশ্চুপ থেকে তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। একজনের কথা বলা শেষ হলে তারপর নিজে কথা বলতে হবে ।

এ সকল উপায় আমরা যদি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের আচরণে পরিণত করি, তবেই আমরা ভালো শ্রোতা হয়ে উঠতে পারব। জীবনে বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করার জন্য ভালো শ্রোতা হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।ব্যক্তিগত আচরণ

ব্যক্তিগত আচরণ কার্যকর সংযোগ স্থাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ারে সফলতা অর্জনে ব্যক্তিগত

আচরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তিগত আচরণ বলতে আসলে কী বোঝায়? ব্যক্তিগত আচরণ হলো- আমাদের আবেগ, অনুভূতি ও মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে চাইলে আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ অবশ্যই পরিশীলিত হতে হবে; আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ এমন হতে হবে যা অন্যের নিকট কেবল গ্রহণযোগ্যই নয়, বরং প্রশংসার দাবিদার। এসো একটি ঘটনা যাচাই করি-

হাসান আলি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় ফিল্ড সুপারভাইজার পদে চাকরি করেন। তার দায়িত্ব হলো মাঠকর্মীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং তাদের কাজের সমন্বয় সাধন করা। একবার একজন মাঠকর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল । হাসান আলি সাহেব এই দুর্নীতির বিষয়ে অবগত হয়ে তার সত্যতা যাচাই করে দেখলেন । অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি ঐ মাঠকর্মীকে ডাকলেন এবং কেন দুর্নীতি করেছেন- তা ব্যাখ্যা করতে বললেন। অভিযুক্ত মাঠকর্মী ইনিয়ে-বিনিয়ে তার অভাব ও নানা সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। হাসান আলি আবেগের বশবর্তী না হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিলেন। ফলে আর কোনো মাঠকর্মী বা অন্য কোনো কর্মী কোনোরকম দুর্নীতিতে জড়ালেন না। এতে একদিকে যেমন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে হাসান আলি সাহেবের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল, তেমনি সংস্থার ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হলো। তিনি যদি দুর্নীতিবাজ কর্মীর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা না নিতেন, তবে হয়তো ঐ অভিযুক্ত মাঠকর্মী আরও বড় ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়তেন। এতে একদিকে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতো, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণও ক্ষতির সম্মুখীন হতো ।

এ তো গেল, কর্মজীবনের কথা। কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের আগেও আবেগ, অনুভূতি ও মনোভাবের

পরিশীলিত অনুশীলন প্রয়োজন ।

আবেগ

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আবেগ আছে। মানুষ কখনো খুব খুশি হয়, আনন্দে লাফিয়ে ওঠে; কখনো ক্ষুব্ধ হয়,

কখনো বিষণ্ণ হয়। মানুষের এই আনন্দ-বেদনা প্রকাশের যে উপায় এগুলোই হচ্ছে আবেগ। আবেগ মানুষের

বিশেষ মানসিক অবস্থা । মানুষের অনুভূতি মিশ্রিত মানসিক অবস্থাকে আবেগ বলে ।

আমাদের দেশকে যে আমরা গভীরভাবে ভালোবাসি, এটি এক ধরনের আবেগ। আবার কোনো কিছু আমরা পছন্দ করি বা অপছন্দ করি সেটাও এক ধরনের আবেগ। আমাদের স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে আবেগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবেগ আমাদের বাস্তব জীবনে চারপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে । আবেগ সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। তবে কোনো বিষয় যদি বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত হয়, কিংবা কোনো দর্শন-নির্ভর হয়, সেক্ষেত্রে ঐ বিষয় সংক্রান্ত আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আবেগের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক কেমন তা অনেকটাই নির্ভর করে তাদের প্রতি আমাদের আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তার উপর। কর্মক্ষেত্রে আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যখন দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহমর্মিতা, বিশ্বাস, আস্থা ইত্যাদি আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল ।আবেগ নিয়ন্ত্রণ

আবেগের ভালো মন্দ দিক দুটোই আছে। ইতিবাচক আবেগ যেমন মানুষকে বিকশিত করতে সাহায্য করে, তেমনি নেতিবাচক আবেগ মানুষকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। আবেগ-আপ্লুত অবস্থায় মানুষ কোনো যুক্তি মানতে চায় না। ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করে যৌক্তিকভাবে নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই আবেগ নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ আবেগে ভেসে না গিয়ে যৌক্তিকভাবে আচরণ করাকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ বলে।

আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায়

জীবনে উন্নতি করতে বা প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে অবশ্যই আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভয়, রাগ, হিংসা, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি ক্ষতিকর আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও ক্রমাগত অনুশীলন । কখনও বিষণ্ণ থাকা চলবে না। মনে রাখতে হবে বাল্যকাল ও কৈশোর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এসময় কোন ভারী দায়িত্ব থাকে না। সুতরাং লেখাপড়ায় ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। সময় পেলে পাঠ্যবই ছাড়াও ভালো ভালো বই পড়তে হবে, বেড়াতে যেতে হবে, খেলাধুলা করতে হবে। মা-বাবার কাছে বিপদ বা সমস্যার বিষয়ে সব খুলে বলতে হবে। ক্রোধ, ঈর্ষা, ভয়, হতাশা এগুলো আবেগের বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ। এ ধরনের নেতিবাচক বা ক্ষতিকর আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে :

১. ক্রোধ, ভয় বা হতাশার সঠিক কারণ চিহ্নিত করা; ২. কারণটি / কারণগুলো দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া;

৩. নির্ভরযোগ্য আত্মীয়, নিকটজন, শিক্ষক, বন্ধু এদের সাথে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা

৪. নির্ভরযোগ্য এবং নিজেকে ভালোবাসেন এমন ব্যক্তির দেওয়া পরামর্শ মেনে চলা;

৫. ভয় বা হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা;

৬. রাগী বা ক্রুদ্ধ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না, এ কথা সবসময় মনে রাখা।

নিয়ন্ত্রিত আবেগ জীবনকে সুন্দর করে, উপভোগ্য করে। অতিরিক্ত আবেগ দ্বারা চালিত হলে নানা রকম ক্ষতি

হতে পারে । তাই আবেগ সামলে চলা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা একান্ত প্রয়োজন ।অনুকৃতি

আবেগের চেয়ে অনুভূতি তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী। কোনো বিষয়, কোনো ঘটনা আমাদের মনের গভীরে বা হৃদয়ের গহীনে যে ভাব তৈরি করে, তাই হলো অনুভূতি । আবেগ আমাদের মনে অনুভূতির জন্ম দেয় ।

যেমন আমাদের আপনজনদের প্রতি আমাদের স্থায়ী ভালোবাসার অনুভূতি রয়েছে। কোনো কাজ যখন আমাদের ভালো লাগে, তখন সেই কাজের প্রতি আমাদের ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যা আমাদের ওই কাজে লেগে থাকতে বা ঐ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কোনো নতুন বিষয় যখন আমাদের সামনে আসে, কোনো নতুন ঘটনা যখন আমাদের সামনে ঘটে তখন সেই বিষয় বা ঘটনার প্রতি তাৎক্ষণিক অনুভূতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের আবেগের জন্ম দেয় ।কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে অনুভূতির গুরুত্ব অনেক। আমরা যখন কোনো চাকরি পাওয়ার জন্য কোনো ধরনের মৌখিক পরীক্ষা দেই, তখন যারা পরীক্ষক হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত থাকেন, আমাদের আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি তাদের মনেও এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয় । তারা যখন কোনো প্রার্থীকে চাকরির জন্য নির্বাচন করেন, তখন তাদের সেই অনভূতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ

ভূমিকা পালন করে।

মনোভাব

কোনো বিষয়, ঘটনা বা মতবাদ সম্পর্কে আবেগ ও অনুভূতির ফলে আমাদের মনে যে ভাবের সৃষ্টি হয় তাই হলো মনোভাব । কোনো বিষয় সম্পর্কে আমাদের মনোভাব দুই রকম হতে পারে- ইতিবাচক মনোভাব ও নেতিবাচক মনোভাব। ইতিবাচক মনোভাব যেমন সাফল্যকে ত্বরান্বিত করে তেমনি নেতিবাচক মনোভাব সাফল্যকে করে বাধাগ্রস্ত। নেতিবাচকের চেয়ে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও মনোভাব সবার কাছেই বেশি গ্রহণযোগ্য। কেউ যদি সত্যিই সফল হতে চান সেক্ষেত্রে তার প্রথম কাজ হবে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা । একটি গল্প হয়তো আমাদের অনেকের জানা। কোনো জুতা কোম্পানির দুজন বিক্রেতাকে পৃথকভাবে পাঠানো হয়েছিল এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জুতার সম্ভাব্য বাজার নির্ধারণ করতে। একজন এসে বলেন যে, ওখানে জুতার কোনো বাজারই নেই। পাঁচ হাজার লোকের বসবাস সেখানে কিন্তু কেউ জুতা পায়ে দেয় না। অপরজন বলেন যে, ওখানে জুতার বাজারের বিপুল সম্ভাবনা কারণ পাঁচ হাজার লোকের কেউই জুতা পায়ে দেয় না । তোমরা কি বলতে পারো, এই দুজনের মধ্যে কার মনোভাব ইতিবাচক আর কার নেতিবাচক ?

একজন নিরাশাবাদী মানুষ অনেক সম্ভাবনার মধ্যেও সমস্যা খুঁজে বের করতে পারেন। আর একজন আশাবাদী মানুষ অনেক সমস্যার মধ্যেও খুঁজে বের করতে পারেন সম্ভাবনা। যখন তুমি কোনো কাজে নেতৃত্ব দেবে তখন ইতিবাচক মনোভাব না থাকলেও হয়তো কাজটি সম্পন্ন হবে কিন্তু তোমার ইতিবাচক মনোভাব সবাইকে তার নিজের সবচেয়ে ভালো কাজটুকু করতে উৎসাহিত করবে। ইতিবাচক মনোভাব কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য খুবই দরকার। তাই আমরা কী করে আরও বেশি ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী। হতে পারি, এসো সেই উপায়গুলো জেনে নিই :

লক্ষ্যের সাথে সংগতি রেখে কাজ করা কোনো কাজ শুরু করার আগে ভাবো এটি কীভাবে তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। যদি তোমার কাজ আর লক্ষ্যের মধ্যে মিল না থাকে তবে তা না করাই ভালো। উদ্দেশ্যহীন কাজ শুধু তোমার সময় আর শক্তিই নষ্ট করবে।

লক্ষ্যে অবিচল থাকা

সাধারণত জীবনের নানা ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং মানুষ যেমন ফলাফল চায় সে অনুযায়ী তাকে পরিকল্পনা করতে হয়। কিন্তু আগে থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট ফল আশা করা একধরনের বোকামি। কোনো কারণে প্রত্যাশিত ফল অর্জন না হলে তা হতাশার জন্ম দেয়। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। যদি সফলতা একবারে না আসে, তবে বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি

মানুষ তার অজান্তেই চারপাশের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অন্যকে মানুষ অনুকরণও করে। এ কারণে ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে মেলামেশা করলে তার প্রভাব পড়বে। আর নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে মিশলে দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক হবে। তাই সবসময় ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে মেশা উচিত ।অন্যদের অক্ষমতা সহজভাবে নেওয়া

সবার কাজ করার ক্ষমতা একই রকম হয় না। যেভাবে তুমি একটি কাজ করতে পারতে ঠিক সেভাবে অন্য কেউ নাও করতে পারে, তাই এটি নিয়ে মন খারাপ করা বা কারও সাথে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা বা খারাপ মন্তব্য করা ঠিক নয় । এটা এক ধরনের হীনমন্যতা ।

অন্যের কাজের প্রশংসা করা

কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হবে তখনই যখন তুমি জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-কষ্টগুলোকে সরিয়ে প্রাপ্তিগুলোকেই বড় করে দেখবে। অন্যদের দেওয়া উপহারগুলোর জন্য হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। অন্যকে তাদের কাজের প্রশংসা করতে ভুলবে না ।

কর্মে সফলতায় মূল্যবোধ

আমরা জেনে অবাক হবো যে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আলবার্ট  আইনস্টাইন ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একটি অফিসের কেরানি হিসাবে।

"Try not to become a man of success,but rather try to become a man of value" Albert Einestein

সেই আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি উক্তি থেকেই বোঝা যায় কর্মে সফলতায় মূল্যবোধ কতটা জরুরি। আইনস্টাইন আমাদেরকে কেবল সফলতার পেছনে না দৌড়িয়ে, মূল্যবোধ অর্জন করতে বলেছেন। মূল্যবোধই একজন মানুষকে প্রকৃত কর্মে সফলতা এনে দিতে পারে সকলের নিকট সম্মানীয় একজন মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। প্রবাদে আছে- “দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য"। আইনস্টাইনের কথায় কিংবা বাংলা প্রবাদে কেন মূল্যবোধকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কীভাবেই বা মূল্যবোধ আমাদের কর্মে বা কর্মক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করে, সে বিষয়ে আমরা জানব।

কর্মক্ষেত্রে মূল্যবোধের কতগুলো ক্ষেত্র নিয়ে আমরা আলোচনা করব-

নির্ভরশীলতা ও আস্থা কর্মক্ষেত্রে আমাদের দলগত কাজ করতে হয়। দলগত কাজের ক্ষেত্রে একজনকে অন্যজনের উপর নির্ভর করতে হয়। আমরা তাদের সাথেই দলগত হয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি যাদের উপর আমরা আস্থাশীল হতে পারি, যাদের কোনো কাজ বা দায়িত্ব দিয়ে তাদের উপর আমরা নির্ভর করতে পারি। তোমরা খেয়াল করলে দেখবে- তাদের সাথেই তোমাদের বন্ধুত্ব হয়, যাদের তোমরা বিশ্বাস করো; যাদের আচার-আচরণ, ভাবনা-চিন্তা, স্বভাব তোমাদের ভালো লাগে; যাদের উপর তোমরা নির্ভর করতে পারো। কর্মক্ষেত্রও এর থেকে আলাদা নয়। কর্মক্ষেত্রেও সবাই তাদের সাথে দল গঠন করতে চায়, যারা দক্ষ এবং যাদের মূল্যবোধ উন্নত, সর্বোপরি যাদের উপর কোনো দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

সততা : ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে যেমন সততা অমূল্য, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও এর মূল্য অপরিসীম। সবাই সৎ লোকের সহকর্মী হতে চায়, সৎ লোককে কোনো কাজ বা চাকরি দিতে চায়। যারা অসৎ, তাদের সবাই ঘৃণা করে, সবাই তাদের থেকে দূরে থাকতে চায়। চাকরিদাতা বা নিয়োগকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একজন চাকরি-প্রার্থীর সততা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। আজকাল চাকরিদাতাগণ অত্যন্ত সচেতনএবং তারা চাকরি-প্রার্থীদের সততার মাত্রা নির্ধারণে বিশেষভাবে দক্ষ। কাজেই কারও যদি মনের ভেতর অসততা থাকে তবে চাকরিদাতাগণ তা সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। ওই চাকরি-প্রার্থী যতই দক্ষ হোক না কেন তাকে চাকরিতে নিয়োগ নেন না। ব্যবসার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য: কেউই অসৎ ব্যবসায়ীদের সাথে লেনদেন করতে চায় না।

নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই কিছু নিয়ম-কানুন আছে। কর্মক্ষেত্রে সফল হতে হলে আমাদের অবশ্যই ঐ সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা উন্নত মূল্যবোধের অংশঃ একজন উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ সব সময় নিয়মানুবর্তী ও সুশৃঙ্খল হয়ে থাকেন। তিনি যে সমাজে বাস করেন, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সেই সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের সকল নিয়ম-কানুন তিনি যেনে চলার চেষ্টা করেন।

সময়ানুবর্তিতা : কর্মক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের কাজ সময়ে করা খুবই জরুরি। এ কথার উপলব্ধি রয়েছে লালনের গানে- 'সময় গেলে সাধন হবে না। কর্মক্ষেত্রে সবাই দলগতভাবে কাজ করে । একজন যদি সময়ম কর্ম সম্পাদন না করে, তাহলে সে জন্য সকলেই বিপদে পড়তে পারেন। এ ছাড়া সময় মতো অফিসে যাওয়া, কিংবা সমরমতো ব্যবসার কাজ শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো প্রতিটি কাজ শেষ করতে পারলে সফলতা অর্জন করা সহজ হয়ে যায় ।

পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বিশ্বাস। কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বিশ্বাস ছাড়া কাজ করা সম্ভব নর। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও বিশ্বাস না থাকে, তবে তারা সৃজনশীল কোনো কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে না। এছাড়া, দলবদ্ধ হয়ে কাজের ক্ষেত্রে দলের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হয়, কোথায় কারও দূর্বলতা থাকলে নিজে এগিয়ে গিয়ে তাকে সহায়তা করা উচিত ।

ক্যারিয়ার গঠনে ব্যক্তিগত আচরণক্যারিয়ার গঠনে ব্যক্তিগত আচরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তোমার ভেতরে কী আছে তা প্রকাশ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো তোমার আচরণ। কোনো মানুষ সৎ না অসৎ তা আমরা তার আচরণের মাধ্যমেই বুঝতে পারি। বদমেজাজি ব্যক্তিকে আমরা পছন্দ করি না। কারণ, তার আচরণ আমাদের স্বস্তি দেয় না। বরং বিরক্তির উদ্রেক করে। পেশাগত জীবনে ভালো করার জন্য আচরণ সংযত ও ভদ্র হওয়া প্রয়োজন । অন্যথায় খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয় । শুধু ব্যক্তিগত সদাচরণ দিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ অসাধারণ সব পদে কাজ করে চলছেন, ছোট উদ্যোক্তা থেকে বিশাল শিল্প-কারখানার মালিক হয়েছেন। ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত আচরণ মার্জিত ও উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। নতুবা, কর্মজীবনের কোনো না কোনো সময়ে সমস্যা হবে, বাধা আসবে ।

আমাদের মন-মানসিকতা, অভ্যাস, বদভ্যাস সবই প্রকাশ পায় আচরণের মধ্য দিয়ে। 'অভদ্রভাবে কথা বলে' এমন কাউকে কোনো প্রতিষ্ঠানই চাকরি দিতে চাইবে না। বরং বিনয়ী এবং ভদ্র কাউকেই মানুষ চাকরি দিয়ে থাকেন। চাকরি, ব্যবসায় ইত্যাদি পেশাগত জীবন গঠনে যে সকল ব্যক্তিগত আচরণ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে তা হলো:

 বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, পরিচ্ছন্ন, সময়ের ব্যাপারে সচেতন এবং কথা ও কাজের মধ্যে মিল;

 ঊর্ধ্বর্তন এবং অধস্তন উভয় সহকর্মীদের সাথে বিনয়ী হওয়া;

জটিল পরিস্থিতিতে রেগে না যাওয়া বা বিরক্তি প্রকাশ না করা বরং হাসিমুখে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া;

চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কিংবা নিজ প্রতিষ্ঠানে কোনো গ্রাহকের সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করা;

 জনসম্মুখে ব্যক্তিগত কাজ না করা;

 বিপরীত জেন্ডারের সহকর্মীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন;

সবার সাথে হাসিমুখে আন্তরিকতার সাথে কথা বলা কোনো সমস্যায় পড়লে সরাসরি সহকর্মীদের সহায়তা চাওয়া এবং তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রাখা;

নিজের অপারগতা সহজভাবে প্রকাশ করা; তবে চেষ্টা না করেই প্রথমে অপারগতা প্রকাশ না করা; 

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভয় না পেয়ে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা;

নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা সবসময় সবার কাছে না বলা

Content added By
Promotion